সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন কী?।। পর্ব-০১ 

[সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন নিয়ে লিখেছেন হেমায়েত উল্লাহ ইমন]

১.

কালচার স্টাডিজের বাংলা কী হবে- ‘সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন’; আপাতত এ বঙ্গানুবাদ সমস্যাজনক মনে না হলেও ‘Culture’ শব্দটির বাংলা কী হবে- কৃষ্টি নাকি সংস্কৃতি, এ নিয়ে কিন্তু বির্তক আছে। তাই কালচার স্টাডিজ বোঝাবুঝির আগে কালচার অর্থে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি কীভাবে হলো জেনে নেওয়া যাক।

ইংরেজি শব্দ ‘Culture’-এর সাথে বাংলা ‘কৃষ্টি’ বা ‘সংস্কৃতি’ ব্যাকরণিক ও ব্যবহারিক অর্থে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ নীহাররঞ্জন রায় তা ‘কৃষ্টি কালচার সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, এখান থেকে তাই মূল বিতর্ক “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সংস্কৃতি’ নাকি যোগেশচন্দ্রের ‘কৃষ্টি’ ” অংশটুকু সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিভিন্ন প্রবন্ধে, বিশেষ করে ১৯৩২-৩৮ সালের প্রবন্ধগুলোতে ‘Culture’ শব্দের অনুবাদ ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে কট্টরপন্থী অবস্থান নিয়েছিলেন। অন্য কেউ দ্বিমত পোষণ করলে তিনি তা নিয়ে পরিহাস করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,  যোগেশচন্দ্রের কলামে ব্যবহৃত ‘কৃষ্টি’ শব্দটিকে তিনি পুরো পত্রিকার ‘ভ্রুণ‘ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ‘কৃষ্টি’ শব্দটিকে চাষবাসের শব্দ, এবং তাকে কোনো বন্ধু ‘কৃষ্টিমান’ ডাকলে বন্ধুত্ব না রাখারও হুমকি দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল বক্তব্য হলো শিল্প-সাহিত্যই সংস্কৃতি—যা মানুষের চিত্ত বা ‘যাতে আশ্রয় করে মানুষ নিজেকে তুলে ধরে’।

নীহার রঞ্জন রায়ের দাবি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতিকুমার ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ এখনও ‘Culture’ এর স্থলে সংস্কৃতি শব্দটি ব্যবহার করে। কারণ রবীন্দ্রনাথের মতো তারাও বিশ্বাস করে জীবনের ‘স্থূল’ কাজগুলো সংস্কৃতি হতে পারে না। অথচ তিনি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংজ্ঞা থেকে দেখান যোগেশচন্দ্রের ‘কৃষ্টি’ শব্দটিই ‘Culture’-এর সবচেয়ে কাছাকাছি। নীহার রঞ্জন রায় ‘সংস্কৃতি’ শব্দের ঘোর বিরোধী। কালচারের বাংলা শব্দ সংস্কৃতি দেওয়ার পিছনে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য রুচি-কে দায়ী করেন। (‘শিল্প, সাহিত্য-ই সংস্কৃতি, মানুষের অন্যসব কাজকর্ম সংস্কৃতি নয়’ এ ধরনের শ্রেণীকরণ)।

 “সংস্কৃতি শব্দটির প্রাচীনতম উল্লেখ, সূচনাতেই বলা হয়েছে, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে; সেই উদ্ধৃতির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ তার রুচি অনুযায়ী অর্থের সন্ধান পেয়েছেন। উদ্ধৃতিটি এই

ও শিল্পানি শংসন্তি দেবশিল্পানি।
এতেযাং বৈ দেবশিল্পানাম অনুকৃতী শিল্পম্ অধিগম্যতে
হস্তী কংসো বাসো হিরণাম্ অশ্বতরীরথঃ শিল্পম্ …. আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি। ছন্দোময়ং বা
এতৈর্যজমান আত্মানং সংস্কৃতে।….”  

(ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা – নীহাররঞ্জন রায়)


তিনি আরো দেখান যে, এক জাতের হিন্দু সমাজে সংস্কার অর্থে সংস্কৃতি শব্দটি প্রচলিত ছিলো, যারা সংস্কার বা সংস্কৃতি বলতে বুঝাতো একটি শিশুর বড় হওয়ার বিভিন্ন স্টেজ- স্টেজগুলোতে প্রায় দশটির মতো যজ্ঞের আয়োজন করা হতো, যা মূলত একটা স্টেজে পরিপূর্ণ হয়ে জীবনের আরেকটা স্টেজে পদার্পণ হওয়া। এ ধারণা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত কালচারের অনুবাদ সংস্কৃতি করেন। যেমন তলস্তয় ‘Cult’ বা ধর্মাচরণ অর্থে কালচার শব্দটি ব্যবহার করতেন।

নীহার রঞ্জন রায় যে অর্থে কালচারকে কৃষ্টি বলতে চেয়েছেন তা নিয়েও সমালোচনা জায়গা আছে, কারণ ‘উৎকর্ষ’ অর্থে কালচারকে ব্যবহার করলে তাও সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়, যা কালচারের একটিমাত্র রূপ। কালের বিবর্তনে সংস্কৃতি শব্দের ব্যবহারিক অর্থ পরিবর্তন পরিমার্জন হয়ে সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন অর্থে একে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

২.
প্রত্নতাত্ত্বিক’রা  সংস্কৃতি বলতে বুঝেন, ‘দেহের বাইরে মানুষের যাবতীয় কার্যক্রমই হলো সংস্কৃতি’ (জয়ন্ত সিংহ রায়)। সমাজবিজ্ঞানীরা তেমনি সংস্কৃতির বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু মোটামুটি সব ডিসিপ্লিন সংস্কৃতি বলতে এখন ‘Way of life’ বোঝানো হয়। যা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সমাজের নির্দিষ্ট মানুষের সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপ ও মূল্যবোধকে বোঝানো হয়। শ্রেণীভেদে সমাজর একেক অংশের একেক সংস্কৃতি হয়ে থাকে। যেমন, রাজধানীর গুলশানে বসবাসকারী মানুষদের কালচার এবং পুরান ঢাকাইয়া মানুষদের কালচার। গুলশানবাসীদের জীবনযাপনকে ‘এলিট কালচার’ বলা হয়। কারণ তাদের ‘Way of life’ ‘জনসাধারণ’-এর মতো না। কয়েকদিন আগে গুলশানে উপ-নির্বাচনে ঘুমের কারণে সকালে ভোটকাস্ট না হওয়ার ঘটনা দেখা যায়; হিরো আলম তাদের শ্রেণী বা কালচারের না বলে তাকে গুলশানে না ঢোকার হুমকি দেওয়া হয়; তাকে পিটানোর রাজনৈতিক কারণ থাকলেও কালচারাল একটা প্রশ্ন কিন্তু ঐখানের জনমানুষের আচরণে স্পষ্ট ছিলো। নাট্যকর্মী মামুনুর রশীদের বক্তব্যে কিন্তু এই কালচারাল বিভাজন স্পষ্ট হয়। তারা একটা গোষ্ঠীর আচার-আচরণকে মানতে চায় না, খারিজ করে দেয় একদম। 

কালচারাল স্টাডিজ কী মামুনুর রশীদের পক্ষে নিবে নাকি হিরো আলমের পক্ষে অবস্থান নিবে?—কালচারাল স্টাডিজ নিরপেক্ষ জায়গা থেকে সবকিছু দেখাতে চায়—স্যোশাল মিডিয়া, মাসমিডিয়া কীভাবে হিরো আলম, টিকটকার অপু ভাইদের তৈরি করে—‘ভাইরাল’, ‘ট্রেন্ডি’ হতে চাওয়ার জায়গায় সোস্যাল মিডিয়া, মাসমিডিয়া কিভাবে মানুষকে ‘পণ্যায়ণ’ করে তোলে তা নিয়ে আলোচনা করে। ঠিক তেমনি রাষ্ট্রও একধরনের ‘কালচার’ চাপিয়ে দেয়। আবার রুচির প্রশ্নে মামুনুর রশীদের রুচিও(এলিট) যে সমস্যাজনক—তা ক্ষমতা কাঠামোর সাথে জড়িত—এবং তা কীভাবে জনসাধারণের রুচি নির্ধারণে ‘আধিপত্য’ বিস্তার করে রাষ্ট্র এবং মার্কেটের মতো—এসবও কালচারাল স্টাডিজের মূল বিষয়।

যাইহোক, আমি কালচারাল স্টাডিজ-কে সাংস্কৃতিক অধ্যায়নই বলব। সাংস্কৃতিক অধ্যায়নের আলাপ শুরু করতে হবে ইউরোপীয় ‘আলোকায়ন’- যুগ থেকে। কান্ট যেমন বলেছিলেন ‘Enlightenment have courage’। সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন এ ‘আলোকায়ন’ বা  ‘এনলাইমেন্ট’-কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ‘ইউরোপীয় রেনেসা’ বা ‘এনলাইমেন্ট’-এর বিজ্ঞান, যুক্তি, স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বকীয়তার বয়ানগুলো অর্থাৎ এনলাইমেন্ট যে লিবারেল হিউম্যানিজমের বয়ান কপচাচ্ছিল তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এবং অর্থডক্স মার্ক্সিজমের সমালোচনারূপে (ফ্রাঙ্কফ্রুট স্কুল, CCC- Center for Contemporary Cultural Study) মূলত কালচারার স্টাডিজের সূচনা হয়। শুরুতে বৃটেনে পরবর্তীতে আমেরিকায়। 

“Cultural Studies is Political, which means ‘power’, ‘power structure’, ‘political dynamics of mass media’ & ‘everyday cultural practice’… Cultural studies are about transforming individual experience, social reality, and power relations.”  (Dr. Kalyani Vallath)

সাংস্কৃতিক অধ্যায়নের প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে এভাবে বলা যায়:  পপুলার কালচার হিসেবে আমরা যে কালচারের চর্চা করছি তা আমাদের বা একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ‘নিজস্ব সংস্কৃতি’ না। তা নির্মিত বা ‘Constructed’—পাওয়ার স্টাকচার ও গণমাধ্যম দ্বারা; এবং এর লক্ষ্যই হচ্ছে জনসাধারণকে পণ্যে রূপান্তর করা। প্রসেসিংটা হেজিমনির মতো অনেকটা। এ ‘নির্মিত’ কালচার থেকে তারা একটা নির্দিষ্টগোষ্ঠীর বা ভৌগোলিক অঞ্চলে ‘আসল’ বা ‘নিজস্ব’ গণ-সংস্কৃতিকে(মাসকালচার) তুলে আনতে চেয়েছেন। বাংলাদেশ লুঙ্গি একসময় মাসকালচার ছিলো, কিন্তু বর্তমানের জিন্সপ্যান্ট জনপ্রিয় কালচার হয়ে ওঠেছে। জিন্সপ্যান্টের সংস্কৃতি কীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, কেন পপুলার কালচার হলো এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনায় এসব কীরকম প্রভাব রাখছে—তা বের করাই সাংস্কৃতিক অধ্যায়নের মূল কাজ। অর্থাৎ জনসাধারণের নিজস্ব জীবন-যাপন, আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও চিন্তা-ভাবনা কিভাবে প্রভাবিত হয়ে ‘নিজস্বতা’ থেকে দূরে সরে গিয়ে ক্ষমতার বশীভূত ও পণ্যে পরিণত হচ্ছে তা-ই কালচারাল স্টাডিজের মূল বিষয়।


উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ভারতীয়-বাংলা সিরিয়ালের বিভিন্ন ড্রেস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে—এতটায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে যে অনেক মেয়েরা ড্রেস কিনতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে বলে শুনেছি। এই যে মাসমিডিয়ার একটা পণ্যকে—মার্কেট ‘অবশ্যক’ করে তুললো বা নির্মাণ করলো—ড্রে্সকে ‘অবশ্যক’ ফ্যাশনের রূপ দিলো তার পিছনে যে ‘পোষাক’ মার্কেটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে—পুঁজিবাদী মনোভাব রয়েছে তা কালচারার স্টাডিজের তাত্ত্বিকরা দেখাতে চান। এভাবেই ‘মাস মিডিয়া’-কে প্রশ্নবিদ্ধ করে— মার্কেটের উপাদানগুলো কিভাবে নির্মিত হয়ে মাস কালচার হয়ে উঠে—এরকম সামাজিক বিভিন্ন টেক্সট ধরে তারা ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করেন।  যেমন : কোকস্টুডিও কতটুকু বাংলার গানের সমৃদ্ধ করছে আর কতটুকু তাদের মার্কেটিং করছে তা নিশ্চয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না।  ক্লাসিক বা বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরে ‘নান্দনিক’ ‘আমাদের’ হিসেবে প্রতীয়মান করা ব্র্যাকের আড়ং কিংবা বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ইন্টিরিয়র ডিজাইনে রিকশা প্রিন্ট্র ব্যবহার করা, টেরাকোটা করানোর নামে পণ্যের দাম মাত্রারিক্ত করা—যা মূলত পুঁজিবাদের ‘Commodity fetishism’ ( কোনোকিছু গুণগত বা বস্তুগত মূলের বিবেচনা বাদ দিয়ে ব্যবহারিক মূল্যের গুরত্ব প্রতিষ্ঠা করা, যেমন ডায়মন্ড, বস্তুগত দিক থেকে এটি গ্রাফাইটের আরেকটি রূপ হলেও বা গুণগত দামের চেয়ে এর ব্যবহারিক মূল্য অনেক বেশি করে নিমার্ণ করা হয়েছে)—অর্থাৎ ক্লাসিকে ফিরে যাওয়ার এই তাড়না বা কালচারটা কিন্তু বৃহার্থে ব্যবসায়িক ক্ষুদ্রার্থে ‘নিজস্বতা বাঁচিয়ে’ রাখা। তেমনি বিভিন্ন ‘ট্রেন্ড’ বলতে যা বুঝি তা এরকম বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে গড়ে তোলা হয়— অর্থাৎ সামাজিক এসেন্স ও ভ্যালু তৈরি করার মাধ্যমে পুঁজিবাদ মুনাফা অর্জন করে। 

৩.

লুই আলথুসারের বিখ্যাত ‘ইন্টারপিলেশন’ (interpellation) থিওরি-কে কালচারাল স্টাডিজের তাত্ত্বিকরা বিজ্ঞাপণের ভাষা বুঝতে কাজে লাগিয়েছে। আপনি আমি গণমাধ্যমের দ্বারা প্রতিনিয়ত ‘সাবজেক্টিফাইং’ হচ্ছি। গণমাধ্যমের এ ‘সাবজেক্টিফাইং’ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের পুপলার কালচার বা ‘নির্মিত গণ-সংস্কৃতি’ গড়ে তুলছে।

‘ইন্টারপিলেশন’ থিওরির ব্যাখ্যা লুই আলথুসার এভাবে দিয়েছেন, ব্যক্তি জন্মগতভাবেই  তার পরিবার, নাম, লিঙ্গ অনুযায়ী ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে প্রতীয়মান হয় । তারপর সারাজীবন এটা বহন করে চলে। আলথুসার এখানে ‘হেইলিং’ এর কথা বলেছেন,  একজন পুলিশ যখন ‘হেই ইউ’ বলে ডাক দেয়, আপনি তখন দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হন। কারণ ‘হিউম্যান সাবজেক্ট’ হিসেবে আপনি ভেতর থেকে একটা তাড়না অনুভব করেন ‘রাষ্টীয় ভাবার্দশ’-এর ডাকে। বাইরের এই ডাকে বা সংবেদনে আমাদের ভেতরে যে তাড়না অনুভব করি বা সংবেদনশীল হয়ে রেসপন্স করি বা সাড়া দিই, ইন্টারপিলেশন বলতে মূলত আলথুসার তা বুঝিয়েছেন। এবং সাবজেক্টিভিটি-ভেদে এই রেসপন্স ভিন্ন হয়ে থাকে, যেমন আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষ পুলিশের ডাকে যেভাবে সাড়া দিবে, একজন প্রশাসনিক কর্মকতা ঐভাবে সাড়া দিবেন না। রাষ্ট্রীয় বা যেকোনো ভাবাদর্শ এবং বস্তুগত আর্দশের এরকম তাড়নায় প্রতিনিয়ত আপনি আমি নিজেদের সাবজেক্ট হিসেবে ডিল করি, এবং প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র, পরিবার, ধর্ম আমাদের সাবজেক্টিফাইং করে।  

এই থিওরিকে কালচারাল স্টাডিজের তাত্ত্বিকরা বিজ্ঞাপণের ন্যারেটিভ বুঝতে কাজে লাগিয়েছেন। পরের পর্বগুলোতে ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপাতত কিছুটা ধারণা দিই, বিজ্ঞাপণের ন্যারেটিভ বা ভাষা খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার সাথে মডেল’রা এমন ভঙ্গিতে কথা বলেন, যেন আপনার জীবনযাপনের সকল সমস্যার সমাধান তাদের কাছে আছে। আপনার স্বাভাবিক জীবনযাপন (সংস্কৃতিও বলতে পারি) মানেই হলো ‘অস্বাভাবিকতা’; আপনার অবশ্যই তাদের প্রোডাক্ট প্রয়োজন ‘স্বাভাবিক’ (বিউটিফিকেশন, পারফেকশন, ভালো-এর নামে) হওয়ার জন্য। যেমন, ‘Glow & Lovely’- এর বিজ্ঞাপনটি খেয়াল করুন।

বিজ্ঞাপনের একটা পর্যায়ে মডেলটি সরাসরি আপনাকে সাবজেক্ট করে বলছে ‘জু আপ কী মিলে’, যার বাংলা করলে এমন হয় যে, ‘আপনি এসব পাবেন’—যাতে আপনার ত্বক উজ্জ্বল হবে। এই যে আপনাকে ভাগিয়ে নিচ্ছে—হেইলিং-এর মাধ্যমে আপনাকে সংবেদনশীল করে তুলছে—আপনার বিউটি আবশ্যক। ‘বিউটিফিকেশন’ এভাবেই মাসকালচার হিসেবে গড়ে ওঠেছে। 

কালচারার স্টাডিজের তাত্ত্বিকরা কিন্তু মাসকালচারের গ্রহণ বর্জনের সমালোচনা করে না, বরং কীভাবে গ্রহণ ‘করানো হয়’, ‘পাটি, বস্তা, রিকশা প্রিন্ট অর্থাৎ ক্লাসিকের যাত্রা গুলশান বনানীর ইন্টিরিয়র ডিজানে কি ভ্যালু তৈরি করে’ এসব নিয়ে কাজ করে। একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ‘নিজস্ব’ কালচার থেকে দূরে সরে যাওয়াটা বা নিজস্বতাকে নিশ্চিহ্ণ করে দিয়ে মাসমিডিয়া বা মার্কেট যে নিজস্ব স্বার্থে কালচার তৈরি করে—ব্যক্তিকে সাবজেক্টিফাইং করে ‘অন্যপথে’ চালিত করে—তাই তাদের মূল বিষয়। এখানে প্রশ্ন আসে তারা কী মূলত পুঁজিবাদের সমালোচনা করে- মার্কসবাদী কি না?  আগেই বলেছি তারা নব্য মার্কসবাদী। 

যাই হোক আলোচনায় ফিরে আসি। সমাজতাত্ত্বিক ম্যাথু আর্নল্ড যেমন বলেছিলেন, ‘Culture is a study of perfection’ অর্থাৎ তিনি হাই-কালচার বা এলিট কালচারকে কেন্দ্র করে কালচারকে বুঝতে চেয়েছেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের তাত্ত্বিকরা এ মতের বিরোধী। কালাচারাল স্টাডিজের গুরু-খ্যাত রেমন্ড উইলিয়াম যেমন বলেছিলেন, ‘Culture is ordinary’ অর্থাৎ সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন সাধারণ মানুষের সাধারন কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে । এটাই এই শাস্ত্রের মূল কথা।

সহায়ক গ্রন্থ

ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা – নীহাররঞ্জন রায় 

john storey :
1. CULTURAL STUDIES: An Introduction 

2. Cultural theory and popular culture


হেমায়েত উল্লাহ ইমন পড়াশোনা করছেন বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি কর্মরত আছেন সহ-সম্পাদক (সাহিত্য বিভাগ), বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকায়।