স্মৃতির পাতায় সমাজের প্রতিচ্ছবি: স্মৃতি, বিস্মৃতি ও স্মরণের আখ্যান
[লিখেছেন মোঃ সাব্বির হোসেন]
সেদিন ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতেই খেয়াল করলাম হালকা ধূসর কাপটিতে ফাঁটল ধরেছে। হঠাৎ মনে পড়লো এমনই একটা চায়ের কাপ ছিল আমার নানার বাড়িতে। নানা প্রতিদিন সকালে সেই কাপে চা খেতেন আর বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়তেন। নানা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম স্পষ্টভাবে মনে পড়লো নানার মুখ, তার নিঃশব্দে চা খাওয়া ও বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়া। সে এক পুরোনো স্মৃতি। এই যে স্মৃতি – এটি আসলে কীভাবে তৈরি হয়? সেই স্মৃতি আবার আমরা ভুলে যাই-ই বা কীভাবে? কীভাবে আবার তা হঠাৎ করে মনে পড়ে আমাদের? এটা কি শুধুই একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়? নাকি আমাদের পরিচয়, ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির দ্বারা এই স্মৃতি, বিস্মৃতি ও স্মরণ প্রভাবিত হয়? আমার লেখাটিতে এই প্রশ্নগুলোর আমি উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছি।
সাধারণভাবে স্মৃতি (Memory) বলতে মস্তিষ্কে তথ্য বা উপাত্ত জমা রাখাকেই বোঝানো হয়। জীববিজ্ঞানের ভাষায়, স্মৃতি হলো এমন একটি জৈবিক ও স্নায়ুবিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জীব বা প্রাণী অভিজ্ঞতাকে সংগ্রহ (Encoding), সংরক্ষণ (Storage) এবং জীবনের বিভিন্ন সময় প্রয়োজন সাপেক্ষে পুনরুদ্ধার (Retrieval) করে (Mujawar et al., 2021)। স্মৃতির প্রক্রিয়াটি মূলত মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রে সংঘটিত হয়, যেখানে সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটি (Synaptic Plasticity) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি হলো স্নায়ুকোষগুলোর (neurons) মধ্যে সংযোগের শক্তি। যখন আমরা কোনো অভিজ্ঞতা লাভ করি, তখন স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে সংযোগ আরও দৃঢ় কিংবা দুর্বল হয় এবং এর মধ্য দিয়েই আমরা স্মৃতি গঠন করি কিংবা কোনকিছু বিস্মৃত হই। এই পরিবর্তন দুই রকমভাবে ঘটে।
- Long Term Potentiation (LTP)– এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে স্নায়ু সংযোগ আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়। অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট তথ্য বা অভিজ্ঞতা যতবার পুনরাবৃত্তি হয়, মস্তিষ্কে সেই তথ্যটি তত গভীরভাবে স্থাপন হয়।
- Long Term Depression (LTD)– এর বিপরীতে, কিছু স্নায়ু সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে, যা অব্যবহৃত তথ্য বা অপ্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতাকে ভুলে যেতে সাহায্য করে।
এই দুই প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে মস্তিষ্কে স্মৃতির ছাপ তৈরি হয়, যাকে Engram বলা হয়। Engram হলো একটি নির্দিষ্ট স্মৃতির জন্য মস্তিষ্কে গঠিত স্থায়ী স্নায়বিক ছাঁচ বা নকশা (Poo et al., 2016)।
তবে সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকেরা স্মৃতিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখা করেছেন। কোন কোন সমাজবিজ্ঞানীর মতে স্মৃতি ধারণ, স্মরণ কিংবা বিস্মরণ হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু জৈবিক বা মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোই
গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থাৎ স্মৃতিকেন্দ্রিক বিষয়গুলো কেবল জৈবিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নয়। বরং স্মৃতির সাথে সমাজ, সংস্কৃতি, পরিচয়, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়গুলোও জড়িত। গবেষকগণ ক্ষুদ্র পরিসরে স্মৃতিকে সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের একটি উপক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেউ কেউ স্মৃতিকে চিহ্নিত করেছেন “সমাজের সংযোগমূলক কাঠামো” (connective structure of societies) হিসেবে। কারো কারো মতে, স্মৃতি হলো স্মরণানুষ্ঠান (commemoration) ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের মতো নির্দিষ্ট কিছু অনুশীলনের মিলন। এক এক শাস্ত্রে স্মৃতিকে ঘিরে হয়েছে এক এক রকম গবেষণা। শুরুতেই আমি আলাপ করবো সামাজিক স্মৃতির ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক পটভূমি নিয়ে।
সামাজিক স্মৃতির ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক পটভূমি
গ্রিক যুগ থেকে সামাজিক চিন্তাবিদদের একটি ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে স্মৃতি। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর আগে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে স্মৃতি নিয়ে আলোচনা এতোটা প্রসিদ্ধ ছিল না। স্মৃতিকে সর্বপ্রথম দেখা হয় “সমষ্টিগত স্মৃতি” বা “Collective Memory” হিসেবে। হুগো ভন হফমান্সথাল ১৯০২ সালে তার লেখায় প্রথম “সমষ্টিগত স্মৃতি” শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, “the dammed up force of our mysterious ancestors within us” and “piled up layers of accumulated collective memory”। আধুনিক কালে এ ধারণাটি পুনরায় ব্যবহার করেন মরিস হালবওয়াকস। তিনি ১৯২৫ সালে প্রকাশিত তার Social Frameworks of Memory গ্রন্থে সমষ্টিগত স্মৃতির বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। পরবর্তীতে শিল্প-ইতিহাসবিদ অ্যাবি ওয়ারবার্গ স্মৃতির ধারণাকে কাজে লাগিয়ে চিত্রকর্মকে ইতিহাসের বাহক হিসেবে তুলে ধরেন।
বার্টলেট (১৯৩২) প্রথম আধুনিক মনোবিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচিত যিনি স্মৃতির সামাজিক দিকগুলোর প্রতি আলোকপাত করেছেন। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় সম্প্রদায়ের গতি-প্রকৃতির ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। নৃতাত্ত্বিক ইভান্স-প্রিচার্ড নুয়ের (The Nuer) গোষ্ঠীকে নিয়ে তার বিখ্যাত গবেষণায় “কাঠামোগত বিস্মৃতি” (structural amnesia) এর ধারণা তুলে ধরেন। এছাড়াও স্মৃতির বিবর্তন (evolution of memory), সময়ের ধারণা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কিত গবেষণায় জ্যানেট, ভাইগোৎস্কি, কুলি (Cooley) ও মীড (Mead) গুরুত্বপুর্ণ অবদান রেখেছেন। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ধ্রুপদী চিন্তাবিদদের মধ্যে ডুর্খেইম (১৯৫১) সময় চেতনাকে (concept of time) স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করলেও, স্মৃতি বিষয়ে তার আলোচনা কেবল প্রাচীন সমাজের স্মরণানুষ্ঠানকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ। জর্জ সিমেল সামাজিক স্মৃতি সম্পর্কে বলেন, “অতীতের সব অনিশ্চয়তা ও বিয়োগবেদনা ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে একটি সংহত রূপ লাভ করে” যা পরবর্তীতে ‘মেমোরি ট্রেস’ কিংবা স্মৃতি চিহ্নিতকরণ ধারণার পূর্বাভাস বহন করে। এভাবে সামাজিক স্মৃতিচর্চা সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কৃতিগত দিকগুলোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠেছে, যেখানে স্মৃতিকে কেবল বিশেষজ্ঞদের চিন্তায় নয়, বরং সাধারণ মানুষের চেতনা গঠনের কাঠামো বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তাহলে স্মৃতির সাথে সমাজ-সংস্কৃতির সম্পর্ক কী? স্মৃতির ধারণা কীভাবে সামাজিক বিজ্ঞানে আসলো?
স্মৃতি হলো অতীত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সেই সংগঠিত রূপ যা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রতীকী ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্মিত, রক্ষিত ও স্থানান্তরিত হয়। স্মৃতিকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রথম ব্যাখ্যা করেন এমিল ডুর্খেইম। পরবর্তীতে তার শিক্ষার্থী হালবওয়াকস এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্প্রসারিত করে দেখান যে, স্মৃতি কেবল ব্যক্তিগত চেতনার দার্শনিক বিশ্লেষণ নয়; বরং এটি সমাজে ব্যক্তি-মানুষের পারস্পরিক কার্যক্রমের ফল। তার মতে, স্মৃতি হলো মানুষ কীভাবে সমাজে পরস্পরের সাথে মিলে চিন্তা করে এবং এই চিন্তন প্রক্রিয়া সমাজ কাঠামোর দ্বারাও যে নিয়ন্ত্রিত হয় তার বহিঃপ্রকাশ। হালবওয়াকস বলেন, মানুষ সাধারণত সামাজিক প্রেক্ষাপটেই তার স্মৃতি অর্জন করে। সমাজের মধ্যেই তারা স্মৃতিকে স্মরণ করে, চিহ্নিত করে এবং নির্দিষ্ট করে। অর্থাৎ, স্মৃতিকে তিনি ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে না দেখে সমষ্টিগত বিষয় হিসেবে দেখেছেন।
তবে সমষ্টিগত স্মৃতির কথা বললেও হালবওয়াকস মূলত চার ধরনের স্মৃতিকে আলাদা করেন। আত্মজৈবনিক স্মৃতি (autobiographical memory), ঐতিহাসিক স্মৃতি (historical memory), ইতিহাস (history) এবং সমষ্টিগত স্মৃতি (collective memory)। আত্মজৈবনিক স্মৃতি হলো সেইসব ঘটনার স্মৃতি যা আমরা ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। যেটি আমার স্মৃতির আলোচনার শুরুতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে মনে পড়েছিল বলে উল্লেখ করেছি। বিপরীতে, ঐতিহাসিক স্মৃতি হলো সেইসব স্মৃতি – যা আমাদের কাছে কেবলমাত্র ইতিহাসের দলিল বা নথিপত্রের মাধ্যমে পৌছায়। অর্থাৎ, যেগুলো সাধারণত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল নয়। ইতিহাস হলো স্মরণকৃত অতীত, যার সঙ্গে আমাদের আর কোনো “জৈবিক” বা জীবন্ত সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই। অন্যদিকে, সমষ্টিগত স্মৃতি হলো সেই সক্রিয় অতীত, যা আমাদের পরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রাখে।
হালবওয়াকস তার সমষ্টিগত স্মৃতির ধারণাকে দর্শনের সীমা ছাড়িয়ে মনোবিজ্ঞানের বিরুদ্ধেও দাঁড় করেছিলেন। সিগমুন্ড ফ্রয়েড যুক্তি দিয়েছিলেন, ব্যক্তির অবচেতন মনে অতীত অভিজ্ঞতাগুলোর এক বিশাল ভাণ্ডার সংরক্ষিত থাকে। তার মতে- মনে রাখা নয়, বরং ভুলে যাওয়া (forgetting) একটি সক্রিয় মানসিক প্রক্রিয়া, যা দমন (repression) ও আবরণী স্মৃতির (screen memories) মাধ্যমে কাজ করে। এই আবরণী স্মৃতি অস্বস্তিকর বা পীড়াদায়ক স্মৃতিগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ সংযোগকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, মনে রাখার চেয়ে আসলে ভুলে যাওয়া সহজ। আর সেই আবরণী স্মৃতিগুলোই আমাদের ভুলে যেতে সহয়তা করে।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী স্মৃতির বিষয়ে মনোবিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রত্যাখ্যান করেন। তারা যুক্তি দেন, ব্যক্তি কোনো ধারাবাহিক ও সুসংহত পদ্ধতিতে স্মরণ করতে পারে না, যদি না সে কোনো সামাজিক গোষ্ঠীর অংশ হয়। হালবওয়াকস বলেন, “স্মৃতিগুলো আমার মস্তিষ্কের এমন এক গোপন কোণে সংরক্ষিত আছে যা অনুসন্ধানে কোনো লাভ নেই, কেননা সেখানে কেবল আমি প্রবেশ করতে পারি। আমি বাহ্যিক সহায়তয় সেসব স্মৃতি স্মরণ করি। আমার সামাজিক গোষ্ঠী আমাকে তা পুনর্গঠনে সহায়তা করে (Olick and Robbins, 1998, p.109)” হালবওয়াকস ছাড়াও অন্য ধারার চিন্তাবিদরা মনোবিজ্ঞানের ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, গাডামার বলেন, “স্মৃতিকে কেবল একটি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতা হিসেবে দেখার প্রবণতা থেকে সরে এসে মানুষের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করার সময় এসেছে” (Olick and Robbins, 1998, p.109)। অনেক লেখক তাদের গবেষণায় রাজনৈতিক ঘটনাবলির সমষ্টিগত স্মৃতি বিশ্লেষণে পুরোপুরিভাবে সামাজিক-মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধরে রেখেও কেউ কেউ সামাজিক, স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ও প্রাগৈতিহাসিক অনুসন্ধানের সংযুক্তি চর্চাকে উৎসাহিত করেছেন।
স্মৃতি বুঝতে হলে যে বিতর্কটি সামনে আসে তা হলো স্মৃতির সাথে ইতিহাসবিদ্যার (Historiography) সম্পর্ক। হালবওয়াকস এই বিষয়ে ছিলেন বেশ সুস্পষ্ট। তিনি বলেন, ইতিহাস হলো “মৃত স্মৃতি” (Dead Memory) – যা অতীত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি, যার সঙ্গে আমাদের আর কোনো জৈবিক অভিজ্ঞতা নেই। এই ধারণা স্মৃতির অর্থবহতাকে ইতিহাসের জ্ঞাতিক (epistemological) দাবির চেয়ে প্রাধান্য দেয় এবং ইতিহাসবিদ্যাকে অতীতের প্রতি গুরুত্বারোপকারী একমাত্র গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে অস্বীকার করে।
গভীরভাবে দেখলে, গতানুগতিক ইতিহাসবিদরাও ইতিহাস ও স্মৃতির মধ্যে এরকমই পার্থক্য করে থাকেন। তাদের মতে, ইতিহাসই কেবল সত্যের অনুসন্ধানে নিয়োজিত পন্থা। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাসবিদরা ইতিহাস ও স্মৃতির মধ্যে এইরকম কাঠামোগত বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। কেননা, ইতিহাসচর্চা এখন দাপ্তরিক’ থেকে ‘সাংস্কৃতিক’ ও ‘সামাজিক’ পরিসরে বিস্তৃত হয়েছে, ফলে স্মৃতি হয়ে উঠেছে একধরনের মৌলিক প্রমাণ।
তবে সমষ্টিগত স্মৃতির সমালোচনাও অনেকে করেছেন। ফেনট্রেস ও উইকহ্যাম সতর্ক করেন যে “সমষ্টিগত স্মৃতি”-র ধারণা ব্যক্তির চিন্তনপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তা ব্যক্তিকে কেবল একটি নিষ্ক্রিয়, সামাজিক ইচ্ছা-নির্ভর যন্ত্রে পরিণত করে। এই কারণে অনেকেই “collective memory” এর পরিবর্তে “cultural memory” বা “social memory” কথাটি ব্যবহার করেন। স্টারকিন সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে এমন এক স্মৃতি হিসেবে দেখান যা প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের বাইরে থেকেও সাংস্কৃতিক উপাদান ও অর্থবোধের সঙ্গে যুক্ত। শোয়ার্জ হর্বার্ট বলেন “collective memory” কার্যকরী ধারণা না হলেও এটি একটি সংবেদনশীল বিশ্লেষণী টুল, যা সামাজিক বাস্তবতা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তবে স্মৃতির সংরক্ষণ ও ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষ নয়; এটি রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে প্রভাবিত। যে স্মৃতি সমাজে ‘স্বীকৃতি’ পায় না, তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় বা ‘ভুলে যাওয়া’ হিসেবে গৃহীত হয়। অন্যদিকে, রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক স্মৃতি ‘স্মরণযোগ্য’ হয়ে উঠে। যেমন – বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাস্কর্য। তবে নতুন ধারার সামাজিক ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন – ভুলে যাওয়া কখনো কখনো সচেতনভাবে নেওয়া একটি সামাজিক সিদ্ধান্ত। যেমন – নতুন জাতীয়তা নির্মাণের প্রয়োজনে অতীতকে ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। এই ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়া স্মৃতির ‘নির্মাণ’কে নির্দেশ করে, যেখানে কী স্মরণে রাখা হবে আর কী বাদ দেওয়া হবে, তা সামাজিকভাবে নির্ধারিত হয়।
স্মৃতির তত্ত্বকথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি জানালার দিকে তাকালাম। আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মনে পড়ে গেল ছোট বেলায় বিদ্যুৎ চমকালে মায়ের কোলে মুখ লুকাতাম। প্রচন্ড ঝড়ো বাতাসে টেবিল থেকে আমার স্কুল জীবনের একটা ডায়েরি নিচে পড়লো। ডায়েরীটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টালাম। ৭ম শ্রেণিতে পড়াকালীন মা-বাবাকে না জানিয়ে বন্ধুদের সাথে একবার সাইকেল নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ডায়েরীতে সেদিনকার রোমাঞ্চ অনুভূতি, ভালো লাগা, ভয় – সব এলোমেলোভাবে লেখা। মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো। ছোট ছোট কতো অনুভূতি হারিয়ে ফেলছিলাম। আজ আবার সেই ডায়েরির পাতার গন্ধেই যেন তা ফিরে এলো।
সেদিনকার ঘটনা দুটিই যেন স্মৃতির আসল চরিত্রটি প্রকাশ করে। অপ্রত্যাশিত, আংশিক, আবেগময় এবং সর্বোপরি সামাজিকভাবে নির্মিত আমাদের স্মৃতি। কোন পুরনো জিনিস–একটি চায়ের কাপ কিংবা একটি ডায়েরি হতে পারে এমন এক মাধ্যম, যা শুধু অতীতকে নয়, বরং আমাদের ভুলে যাওয়া স্মৃতির অংশকেই আবার জাগিয়ে তোলে। এভাবেই স্মৃতি গড়ে ওঠে, হারায় এবং নিঃশব্দে ফিরে আসে। এভাবেই আমরা স্মৃতি গড়ি, বিস্মৃত হই, আবার স্মরণ করি।
তথ্যসূত্র
- Olick, J. K., & Robbins, J. (1998). Social memory studies: From “collective memory” to the historical sociology of mnemonic practices. Annual Review of sociology, 24(1), 105-140.
- Mujawar, S., Patil, J., Chaudhari, B., & Saldanha, D. (2021). Memory: Neurobiological mechanisms and assessment. Industrial psychiatry journal, 30(Suppl 1), S311-S314.
- Poo, M. M., Pignatelli, M., Ryan, T. J., Tonegawa, S., Bonhoeffer, T., Martin, K. C., & Stevens, C. (2016). What is memory? The present state of the engram. BMC biology, 14(1), 40.
